বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যাকে বাংলা উপন্যাসের জনক বলা হয়। বাংলা সাহিত্যে অনেক অবদানের জন্য বাংলা সাহিত্যে তিনি অমর হয়ে আছেন সকলের মনে। আমরা হয়তো অনেকেই কমলাকান্ত নামের সাথে পরিচিত কিন্তু আপনি জানেন কি কমলাকান্ত এই ছিল এই মহান মানুষের ছদ্মনাম।
তার জীবনে একদিকে তিনি ছিলেন সাহিত্যিক ও অন্যদিকে একজন সাংবাদিক। ১৯ শতকের বাংলা সাহিত্যিক ও সাংবাদিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর জীবনী জানবো আজকের আর্টিকেলে। আপনি যদি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর জীবনী সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চান তাহলে আর্টিকেল টি শেষ পর্যন্ত পড়ার চেষ্টা করুন।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্রোপাধ্যায় জীবনী
বাংলা সাহিত্য যখন চরম আধারে ও দুর্দিনে নিমজ্জিত ছিল ঠিক তখন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যেন বাংলা সাহিত্যের মধ্যে প্রান ফিরিয়ে আনেন। মৃত প্রায় বাংলা সাহিত্য কে যিনি জীবিত করেছিলেন তিনি হলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তিনি ছিলেন দেশপ্রেমিক, সাহিত্যের সম্রাট, বাংলা সাহিত্যের জনক।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর জন্ম
২৬ জুন ১৮৩৮ সনে বর্তমান উত্তর পরগনা জেলার নৈহাটি নামক গ্রামে জন্মগ্রহন করেছিলে সাহিত্যের সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তার পিতার নাম ছিল রামহরি চট্রোপাধ্যায় ও মাতার নাম দুর্গাসুন্দরী দেবী। পরিবারের মধ্যে তৃতীয় সন্তান ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তার বড় দুই ভাইয়ের নাম ছিল শ্যামাচরণ ও পূর্ণচন্দ্র।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর শিক্ষা জীবন
জন্মের পরে ৬ বছর বয়স পর্যন্ত বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কাঠালপাড়াতে বাস করতেন। তাদের কুল-পুরোহিত বিশ্বম্ভর ভট্রাচার্যের মাধ্যমে তার শিক্ষা জীবনের শুরু হয়। শিশুকাল থেকেই বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন অত্যান্ত মেধাবি। তিনি পাঠশালায় গিয়ে পড়াশুনা করেননি তিনি বাড়িতে বসে গৃহ শিক্ষক রামপ্রাণ এর কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতেন।
১৮৪৪ সালে তার পিতার কর্মস্থলে স্কুল জীবনের সূচনা করেন। মোদিনীপুরে একজন ইংরেজি শিক্ষক “এফ টিড” পরামর্শে তার পিতা তাকে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তি করান। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় স্কুল জীবনেও অসামান্য মেধার অধিকারি ছিলেন।
তিনি তার স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করে। তার ভালো ফলাফল দেখে ইংরেজি শিক্ষক “এফ টিড” তাকে ডাবল প্রমোশন দিতে উদ্যত হয়েছিলেন। স্কুল জীবনেই তিনি শিক্ষক “সিনক্লেয়ার” কাছে দেড় বছর ইংরেজি শিক্ষা নিয়েছিলেন।
১৮৪৯ সালে আবার তিনি কাঠালপাড়ায় ফিরে আসেন এবং সেখানে “শ্রীরাম ন্যায়বাগীশের” কাছে বাংলা ও সংস্কৃত বিষয়ে শিক্ষা নেয়া শুরু করেন। এর পাশাপাশি তিনি পন্ডিত “হলধর তর্কচূড়ামণির” কাছে নিয়মিত মহাভারত শুনতেন।
তার কলেজ জীবন শুরু হয় ১৮৪৯ সালে হুগলি কলেজে। সেখানে তিনি ৭ বছর অধ্যায়ন করেছিলেন ও ১৮৫৩ সালে হুগলি কলেজ থেকে জুনিয়র স্কলারশিপ পরীক্ষায় প্রথম স্থান লাভ করেন। প্রথম স্থান অধিকার করায় তিনি পুরস্কার হিসেবে প্রতি মাসে আট টাকা বৃত্তি পেতেন।
তিনি ১৮৫৬ সালে সিনিয়র বৃত্তি পরিক্ষায় সকল বিষয়ে কৃতিত্ব দেখান। ১৮৫৬ সালেই আবার তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে আইন নিয়ে অধ্যায়ন শুরু করেন। ১৮৫৭ সালে তিনি আইন বিভাগ থেকে এন্ট্রাস পরীক্ষায় প্রথম বিভাগ অর্জন করেন। একই বছরে তিনি বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম স্নাতক ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কর্মজীবন
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কর্মজীবন শুরু করেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর হিসেবে। কর্মজীবন থেকেই তিনি সাহিত্য চর্চা শুরু করেন। ছাত্রজীবন থেকেই পত্রিকায় তিনি কবিতা লিখতেন। কর্মজীবনে তিনি তার নিজ পত্রিকা “বঙ্গদর্শন” সেখানে তিনি সাহিত্য, বিজ্ঞান, ভাষাতত্ত্ব, অর্থনীতি, ধর্ম, প্রত্নতত্ত ইত্যাদি বিষয়ে প্রবন্ধ লিখতেন। তিনি দীর্ঘ ৩৩ বছর সরকারি চাকরিতে কৃতিত্ব ও ন্যায়পরায়ন হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় দাম্পত্য জীবন
১৮৪৯ সালে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রথম বিবাহ করেন ১১ বছর বয়সে। নারায়নপুর গ্রামের এক পঞ্চমবর্ষীয়া মেয়ের সাথে। তিনি যখন চাকরি জীবনে যশোর অবস্থান করেন তখন ১৮৫৯ সালে তার পত্নীর মৃত্যু হয়। এর পরে ১৮৬০ সালে হালি শহরের চৌধুরী বংশের কন্যা রাজলক্ষী দেবীর সাথে তার দ্বিতীয় বিয়ে হয়।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সাহিত্য কর্ম
বাংলা সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর ছিল সবচেয়ে বেশি অবদান। ১৯ শতকে বাংলা সাহিত্যের ছিল চড়ম দুর্দিন এর সময়। তখন সাহিত্য কর্মের মাধ্যমে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্য কে প্রান ফিরিয়ে দেন। এ কারণেই বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কে বাংলা সাহিত্যের জনক বলা হয়। তিনি তার সাহিত্যকর্মে সামাজিক, রম্য, ঐতিহাসিক ও ধর্মিয় বিষয়ে লিখেছেন।
তার প্রথম লেখা উপন্যাস হলো “দুর্গেশনন্দিনী” যা বাংলা সাহিত্যের একটি স্বার্থক উপন্যাস। তিনি সাহিত্য জীবনে মোট ১৫ টি উপন্যাস রচনা করেন যার মধ্যে একটি ইংরেজি উপন্যাস ও ছিল। তার উল্লেখ্যযোগ্য কয়েকটি উপন্যাস হলো – দুর্গেশনন্দিনী, দেবিচৌধুরানি, সীতারাম, রাজসিংহ, বিষবৃক্ষ, ইন্দিরা, কৃষ্ণকান্তের উইল ইত্যাদি।
তিনি ছিলেন বাংলা সাহিত্যের একজন খ্যাতিমান প্রবন্ধকার। তার প্রবন্ধে তিনি দেশ প্রেম, ধর্ম তত্ত্ব, ঐতিহাসিক বিষয় গুলো তুলে ধরতেন। তার লেখা প্রবন্ধ “আনন্দমঠ” মানুষের মাঝে দেশ প্রেমের বিষয় টি ভালো ভাবে ফুটিয়ে তোলেন। এই প্রবন্ধের একটি গান “বন্দে মাতরম”১৯৩৭ সালে ভারতীয় কংগ্রেস স্তোত্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেন।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লেখা উপন্যাস
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তিনি মোট ১৫ টি উপন্যাস রচনা করেন যেগুলো হলো:
- দুর্গেশনন্দিনী
- কপালকুণ্ডলা
- মৃণালিনী
- বিষবৃক্ষ
- ইন্দিরা
- যুগলাঙ্গুরীয়
- চন্দ্রশেখর
- রাধারানী
- রজনী
- কৃষ্ণকান্তের উইল
- রাজসিংহ
- আনন্দমঠ
- দেবী চৌধুরানী
- সীতারাম
- Rajmohan’s Wife (ইংরেজি উপন্যাস)
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রবন্ধ গ্রন্থ
- কমলাকান্তের দপ্তর
- লোকরহস্য
- কৃষ্ণ চরিত্র
- বিজ্ঞান রহস্য
- বিবিধ সমালোচনা
- প্রবন্ধ- পুস্তক
- সাম্য
- মুচিরাম গুড়ের জীবনচরিত
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত বিবিধ
- ললিতা
- ধর্ম্মতত্ত্ব
- সহজ রচনা শিক্ষা
- শ্রীমদ্ভগবদগীতা
- কবিতা পুস্তক
- বঙ্কিমচন্দ্র চট্রোপাধ্যায় সম্পাদিত গ্রন্থাবলী
- দীনবন্ধু মিত্রের জীবনী
- বাঙ্গলা সাহিত্যে প্যারিচাদ মিত্রের স্থান
- সঞ্জীবচন্দ্র চট্রোপাধ্যায়ের জীবনী
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় স্বীকৃতি
বঙ্কিমচন্দ্র চট্রোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যাক্তি ছিলেন। তিনি কর্ম জীবনে নিষ্ঠা ও সততার সাথে কাজ সম্পাদন এর কারনে ব্রিটিশ সরকার থেকে দুটি খেতাব লাভ করেছিলেন। ১৮৯১ সালে তিনি “রায় বাহাদুর” খেতাব পান ও ১৮৯৪ সালে তিনি “কম্পানিয়ন অফ দ্যা মোস্ট এমিনেন্ট অর্ডার অফ দ্যা ইন্ডিয়াব এম্প্যায়ার” খেতাব লাভ করেন।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মৃত্যু
বাংলা সাহিত্যের সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় শেষ বয়সে বহুমুত্র রোগে ভোগেন। তিনি ৮ এপ্রিল ১৮৯৪ সালে ৫৫ বছর বয়সে মৃত্যু বরন করেন।
FAQs
আর্টিকেল সম্পর্কিত কিছু প্রশ্ন ও তার উত্তর নিচে দেয়া হলো:
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় উপন্যাস কয়টি?
বঙ্কিমচন্দ্র চট্রোপাধ্যায় উপন্যাস সংখ্যা মোট ১৫ টি যার মধ্যে ইংরেজি ভাষায় একটি লিখেন।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মতে সাহিত্যের উদ্দেশ্য কি?
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতে “সত্য ও ধর্ম” হলো সাহিত্যের উদ্দেশ্য। তিনি মনে করেন, খ্যাতি লাভ ও অর্থ লাভ এর জন্য সাহিত্য নয় বরং সাহিত্য লিখতে হবে মানুষের জন্য যা দিয়ে মানুষের কল্যান সাধিত হয়।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছদ্মনাম কি?
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় পত্রিকায় বিভিন্ন ধরণের লেখা প্রকাশিত করতেন সেখানে তিনি তার ছদ্মনাম হিসেবে কমলাকান্ত ব্যাবহার করতেন।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কে বাংলা উপন্যাসের জনক বলা হয় কেন?
উনিশ শতকের প্রথম আধুনিক ঔপন্যাসিক বলা হয় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে। বাংলা সাহিত্যে অনেক বেশি অবদান এর কারনে তাকে উপন্যাসের জনক বলা হয়।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত প্রথম উপন্যাস কোনটি?
“দুর্গেশনন্দিনী” যা ছিল বাংলা সাহিত্যের একটি স্বার্থক উপন্যাস।
শেষ কথা
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জীবনী আর্টিকেলে আমরা তার জীবন সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় গুলো তুলে ধরেছি। বাংলা সাহিত্যের এই অমর সাহিত্যিক এর জীবন আদর্শ ছিল সততা, ধর্ম। তিনি আইনজীবী হিসেবে কর্মজীবনে নিষ্ঠার সাথে কাজ সম্পাদন করেছেন। আর্টিকেল টি পড়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
অন্য পোস্ট পড়ুন-